আমাদের প্রজন্মের সকলেরই ছোট বেলা বোধ হয় খানিকটা একইরকম। আমরা বিকেলে মাঠ এ খেলতে যেতাম, সন্ধ্যেবেলা মা ডাকলে বাড়ি ফিরতাম ,দু চার ঘা হাতপাখা র বাড়ি কিম্বা একটা আধটা চড় চাপড় ও জুটত অন্ধকার হয়ে গেছে বলে, যদিও বুঝতে পারিনি যে সূর্য ডুবে গেছে তো আমি কি করব ! আমাদের তখনকার জীবন ছিল নেহাৎ ই ধীর, টিভি তে এত চ্যানেল ছিল না , ইন্টারনেট ছিল না , ছিল রোজ সন্ধ্যেবেলা কারেন্ট গেলে ছাদে গিয়ে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে শুয়ে গল্প শোনা, আকাশের তারা চেনা। উপরি পাওনা বলতে রথ , রাসের মেলা, ঝুলন এইসব গোটাকতক গ্রাম্য বিনোদন। তখন আমাদের Facebook এ বন্ধু পাতাতে হত না , এ পাড়ার , ও পাড়ার সবাই এমনি বন্ধু হয়ে যেত , আর সেখানে খুব বেশি ভেদাভেদ ও ছিল না , আমার এরকম অনেক বন্ধু ছিল বিকালে খেলার সঙ্গী , যাদের মা বাড়ি বাড়ি কাজ করতেন। সারা বিকেল খেলে এসেই সন্ধ্যেবেলা পড়তে বসে ঢুলতাম খুব, ঘুম পেয়ে যেত তাড়াতাড়ি , অবশেষে রাত সাড়ে নটা বাজতেই খেয়ে দেয়ে ঘুম , টিভি তে বড়জোর খবর চলছে তখন। কোনো কোনো দিন আবার সন্ধ্যেবেলা হঠাত করে মাথায় উকুন আবিষ্কার হত , ব্যাস , পড়াশুনো সব শিকেয় , সরু চিরুনি নিয়ে মা উকুন তাড়াতে উদ্যোগী হয়ে পড়ল , আর বলাই বাহুল্য যে ফ্রি তে দেদার বকুনি। তারপর পড়তে বসেও HW গুলো কোনো ক্রমে শেষ হলেই মনটা কীরম উরু উরু করত , পুজোসংখ্যা আনন্দমেলা তো দু হপ্তাতেই শেষ , তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে হাত বাড়াতাম দেশ কিম্বা আনন্দবাজার পত্রিকার দিকে , এ ছাড়া ছিল ফি সপ্তাহে লাইব্রেরি র বই , তারপরেও এদিক ওদিক থেকে বই র সম্ভার কম হত না , পড়ার বই খাতা র তলায় খুজলেই পাওয়া যেত তাদের। এ ছাড়া আমার নিজস্ব আর একটা টাইম পাস করার পন্থা ছিল বাংলা calender খুলে দিন গোনা ; অমুক দিন এই পুজো , তমুক দিন সেই পরব , দূর্গা পুজো আসতে আর ঠিক কত দিন বাকি, এ সব গুনতাম বসে। এই ছিল ছোট বেলা র দিনগুলো।
যাই হোক, গরম এর ছুটি র পর কিছুদিন বাদেই আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর এর অধিকর্তা কোন এক গোলদার ঘোষণা করে দিতেন বর্ষা এসে গেছে। আর তখন এরকম নিম্নচাপ হাইজ্যাক হত না , ফলে ভালই বৃষ্টি হত আর চারিদিকে জল জমত। এরকমই ক্লান্ত একঘেয়ে দিনে নোটিশ আসত ক্লাসে , অমুক দিন রথযাত্রা উপলক্ষে ছুটি।কি আনন্দ। আগের দিন থেকে সে কি উত্তেজনা, বাবা নিয়ে এসে দিতেন একটা রথ আর কাগজ এ মোড়া ঠাকুর , জগন্নাথ , বলরাম , সুভদ্রা। ময়দা জ্বাল দিয়ে আঠা তৈরি হত ,মা কাকীমা রা সাজিয়ে দিতেন রঙ্গীন কাগজ, ফুলের মালা দিয়ে। তারপর বিকেল হতেই নকুলদানা কিম্বা পেয়ারা র টুকরো সাজিয়ে রথ নিয়ে বেরোনো হত। এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে কাকীমা, জেঠিমা ,দিদা সবাই ঠাকুর নমস্কার করতেন , প্রনামী ও জুটত আটানা, এক টাকা। দিন শেষে গুনে দেখা গেল পুরো ছ টাকা আয় হয়েছে। সেকী আনন্দ , আমার নিজের টাকা। আগামী বেশ কিছুদিন কালু কাকুর দোকানের রেগুলার কাস্টমার আমি ,হজমী অথবা scented পেন , কি মৌরী লজেন্স , অথবা জলছবি। জগন্নাথ এর কৃপায় দিন গুলো নেহাত বোরিং হলেও মন্দ ছিল না। এক সপ্তাহ বাদে আবার উল্টো রথ , তবে কিনা ওতে ছুটি পাওয়া যেত না ! ফলে আমার রথে চেপে জগন্নাথ ভাই বোন নিয়ে মাসির বাড়ি গিয়েই ক্ষান্ত হতেন , ফিরতি ride মিলত না আর।
তবে সমাজ এ সব কিছুর ই evolution হয় , পালা পার্বন এর ও। এখনকার বাচ্চারা অনেকে জানেই না , দ্যাখেই নি ,রথ কিভাবে টানে। যদিও আমাদের মত মফস্বল এ এখনো রথ এ মেলা বসে , লোকে পাপড় ভাজা খায়, গাছ কিনে আনে। তবে বাচ্চাদের এসব আর খুব একটা টানে না , হয়ত স্বাভাবিক, ওরা জন্মে থেকে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক দ্যাখে, কিম্বা ফেইসবুক এ farmville খেলে, এই সব ধীর গতির গ্রাম্য আনন্দ ওদের মন ভরবে কি ভাবে ? আসলে সমাজে পরিবর্তন একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্থ। আমরাও গাজন এর মেলায় যায়নি কখনো। টুসু , ভাদু কিম্বা ইতুর ষষ্ঠী করিনি। হয়ত আমাদের দিদা রাও তখন অভিযোগ করেছেন ,কষ্ট পেয়েছেন তাদের ছোটবেলা শেষ হয়ে যেতে দেখে। এভাবে হয়ত রথযাত্রা ও একদিন আর থাকবে না। আসলে পৃথিবী টা ধীরে ধীরে গ্লোবাল গ্রাম হয়ে পড়ছে কিনা।