পূর্বরঙ্গ
"ishrat-e-qatra hai dariyā meñ fanā ho jaanā
/ dard kā had se guzarnā hai davā ho jaanā ।।"
/ dard kā had se guzarnā hai davā ho jaanā ।।"
প্রিয় গালিবের শহরের শুক ও সারি , কথক ঠাকুরের গুলাবো ও সিতাবো ।ঝগড়া, লড়াই, ভালোবাসা - এক ঝরা সময়ের সাক্ষী। শীতের রাতের মায়াবী ঘন কুয়াশায় কান পাতলে শোনা যায় জমে থাকা নিঃশ্বাসের শব্দ - লক্ষ্নৌ নগরীর অলি- গলির রৌনাক- শৌনক, উত্থান- পতনের দীর্ঘশ্বাস।
জমাটি শীতল অন্ধকারের মধ্যে থেকে ভেসে আসে প্রথম রাত্রের মেহফিলের রোশনাই ; প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে যেরকম জ্বলে ওঠে ! নোনা ধরা ইঁটের দেওয়াল থেকে বের হয় সুবাসিত গুলাবী আতর। পানপাত্র ঠোঁটে রেখে অভিসারি প্রেমিকার কটাক্ষ। আরঞ্জিত সে ঠোঁটে আলতো ছুঁয়ে যায় আঙ্গুল। জমে ওঠে ঠুমরির তান। মাদকাসক্ত প্রেমিকের শায়রী যেন আগুনের ফুলকির মতো জ্বলে ওঠে। এরশাদ !
"কটাক্ষে মরিয়া যায়
কটাক্ষে বাঁচিয়া উঠে
হাসিতে হৃদয় জুড়ে
হাসিতে হৃদয় টুটে "
রাতের অন্ধকার আরো জমে উঠলে নর্তকীর ঘুঙরু একটু বেতালে শোনায় ।আলিঙ্গনাবদ্ধ শিথিলবসনার হাত থেকে গড়িয়ে যায় সুরাপাত্র।সেই মদিরার বাষ্প জমে বাতাস ক্রমশ ভারী, ঠিক শেষ রাত্রের গণিকালয়ের মতো।তারই মধ্যে মিশে যায় বিগতযৌবনার শৈথিল্য-হাহাকার, ঠিক যেন বাতিল, ঝরে পড়া ফুলমালার নৈরাশ্য।
"আজ যানে কি জিদ না করো.."
নগরীর মাথার ওপর ফ্যাকাশে চাঁদ সূর্যের মতো জ্বলে।সর্পিলাকার অলি-গলি ধরে বয়ে চলে বৈপরীত্যের সমাপতন। কোথাও যৌবনের সমারোহ তো কোথাও বার্ধক্যের নিঃসঙ্গতা। কোথাও বৈভবের প্রাচুর্য তো কোথাও দারিদ্র্য যন্ত্রনা। প্রেম, বিরহ, অভিমান, অন্তর্ঘাত, দ্বেষ, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য - নাগরিক রাত্রির মুহূর্ত সমূহ যেন প্রতিটি তন্ত্রী তে বিচ্ছুরিত এক সম্মিলিত অনুরণন।
রাত শেষ হয় ক্রমে; ভেসে আসে ফজরের নামাজের আজান ধ্বনি। মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি মিশে যায় তাতে। গোমতীর ধারে, দিক্চক্রবালে আবারও একটা চন্দ্রাস্ত হয়।
"যব ছোড় চলে লাখনৌ নাগরী।..."
সেই রাম ও নেই, সেই অযোধ্যা ও নেই।
নবাবীয়ানা, ভুলভুলাইয়া, ব্রিটিশ রেসিডেন্সি, মিউটিনি, ওয়াজেদ আলী .. ইতিহাস হয়তো মনে রেখেছে কিছু, বা অনেকটাই রাখেনি। তবে লক্ষ্নৌ নগরীর গুলাবো -সিতাবো কিন্তু এখনো গল্প শোনায় নিরন্তর, রুমি দরওয়াজা কিংবা চকের ধারে বসে - সেই সব কথা, যা পৃথিবী ভুলে গেছে। তবু ওরা বলে চলে- সেই সব প্রাসাদ, সেই সব ফেলে আসা রূপকথার গল্প, যা একদিন ছিল লক্ষ্নৌ নগরীর গর্ব।
'সকলি ফুরায় ফুচকার প্রায়, পড়ে থাকে শালপাতা'
কোনো এক অখ্যাত গলির ভিতর শতাব্দী প্রাচীন অট্টালিকা - বয়সভারে এবং অতি ব্যবহারে ক্লান্ত, জীর্ণ। কালের প্রকোপ যেরকম সব ভুলিয়ে দেয়, এই অস্থিচর্মসার স্থাপত্য কীর্তি নিজেও ভুলতে বসেছে, যে এর ও একদিন যৌবন ছিল। কেউ ভালোবেসে নামকরণ করেছিল তার - 'ফতিমা মহল'।এখানেও একদিন প্রতিরাত্রে মেহফিল সাজতো, চৌকাঠ গমগম করতো কত মানুষের আনাগোনায় ।এখনও হয়তো কোনো কোনো রাত্রি শেষের স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে - গতজন্মের স্মৃতির মতো সেই সব দিনগুলো।আরো একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে, আরও একদিন বয়স বেড়ে যায় ওই জীর্ণ হাভেলীর। সেই ফ্যাকাসে চাঁদ টা এখনো জ্বলে মাথার ওপর। বাঁধভাঙা নরম সাদা আলোয় ধুয়ে যায় সুবিশাল তার অঙ্গন।চারপাশে মায়ার মতো ঘিরে থাকে আলো অন্ধকারে ঘেরা, ভেঙে পড়া বারান্দা।কিছু আঁধার, কিছু রহস্য সেই কোন প্রাচীন কাল থেকে ধুমায়য়িত হয়ে আছে ওখানে।বসন্তের গুনগুন বাতাসের মতো সেই জ্যোৎস্নালোক যেন ফিস ফিস করে বলে যাচ্ছে তার কানে কানে,
- অট্টালিকা তুমি কি শুধুই বাড়ি, প্রাণ নেই গো তোমার?
অমনি অন্ধকার এসে ছুঁয়ে দেয় আবার তাকে। অট্টহাস্য করে ওঠে সেই অট্টালিকা। মৃত্যুযন্ত্রণার মতো হাহাকার ছড়িয়ে পরে দিকে দিকে।
- না না, মৃত্যু হয়েছে আমার। এটা পরকাল, দেখতে পাচ্ছনা ? সব অশরীরী এখানে।রূপকথারা সত্যি হয়না গো; ফিরে যাও চন্দ্রালোক, কোনোদিন মিলন হবে না আমাদের।
**************************************************************************************
আবহ
গুলাবো-সীতাবো হলো সেই শুক ও সারি । যারা রূপকথার গল্প শুনিয়ে চলে, অবিরাম।
আমাদের গল্প শুরু হয় শতাব্দী প্রাচীন এই ফতিমা মহলে বসেই ।অমূল্য হাভেলিটির মালকিন হলেন ফতিমা বেগম, আব্বুর আদরের ফিত্তু আজ অশীতিপর বৃদ্ধা। বয়সভারে স্মৃতিভ্রষ্টা কিঞ্চিৎ, তবে আভিজাত্যের রক্ত এখনো ধমনীতে প্রবহমান। হোক না গৌরব অস্তমিত, তবু তো তিনি বেগম। নিত্যক্ষনের সঙ্গী তাঁর আদরের পরিচারিকা 'দুলহান', মাথায় মেহেন্দি করা কিংবা পান সেজে দেওয়ার হুকুমে তটস্থ। হাজার হোক, বেগম সাহেবার আবদার বলে কথা।
আর আছে এই গল্পের আলোকবর্তৃকার কেন্দ্রস্থলে, প্রদীপের নিচের অন্ধকারের মতো কোনো এক মির্জা, না না গালিব নয়। বয়সভারে ন্যুব্জ, জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত এক পরাজিত সৈনিক। অবিন্যস্ত পোশাক, ফেজটুপি। বেমানান মোটা চশমা র তলায় দুটি কোটরাগত ক্লান্ত চোখ। সে চোখের তারায় তারায় জমে আছে শুধু খিদে -জ্বালা, নিরাশা, একাকিত্ব আর লালসা। এই বিশাল অট্টালিকার একমাত্র দেহরক্ষীর মতো - যদিও ওই অমূল্য ইমারতকে তার ভালোবাসা শুধুই পার্থিব মূল্যের জন্য। লোকে বলে মরা হাতি লক্ষ টাকা। তাই সবার অলক্ষে ওই খসে পড়া ইমারতের আনাচে কানাচে থেকে তার জহুরীর চোখ খুঁজে নেয় রত্ন - কখনো একটা বাতিল ঝাড়বাতি কিংবা কখনো কিছু পুরোনো মুদ্রা। কথায় বলে, 'জো দিখতা হয়, ও বিকতা হয়'।
এছাড়া আছে পরজীবীর মতো উদ্বাস্তু, জীর্ণ হাভেলীর আঁকে-বাঁকে আশ্রয় নেওয়া বাঁকের মতো কিছু না মানুষের কাহিনী, যাদের কথা কেউ বলবেনা কোনোদিন। দারিদ্রের সঙ্গে, জীবনের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে গিয়ে যাদের জীবনটাই সম্পূর্ণ বিকিয়ে গেছে।
আরও যা আছে, তা হলো এক প্রেম - অপ্রেমের দ্বন্দ্ব। আবহমান কাল ধরে বয়ে আসা নর - নারীর সম্পর্ক বড়ো জটিল। মির্জা আর বেগম, এক অসমবয়সী প্রেম। মহাকালের প্রকোপে ভুলতে বসা এক অদ্ভুত সম্পর্ক।তাদের নিজেদের ও মনে পড়ে না, তাদের প্রেমের উত্থান-পতন বা ইতিহাস।আসলে মানুষ - মানুষির ঊর্ধে উঠে এই সম্পর্ক আসলে দুজন মানুষের একটি মনুষ্যেতর ইমারতের সঙ্গে। এই ফাতিমা মহল যেন কোনো ইট - চুন - সুরকির স্থাপত্য নয়, শতাব্দী প্রাচীন অভিশপ্ত, জীর্ণ আরও একটি মনুষ্য দেহ, বয়সভারে ক্লান্ত।
'গুলাবো-সীতাবো' তাই আসলে শুধুই একটি রূপকথা, ফতিমা মহলের একান্ত নিজস্ব।
**************************************************************************************
পরিশেষে
গুলাবো - সীতাবোর প্রতিটি দৃশ্যে উঠে এসেছে এমন সব কাব্যিক চিত্র কল্প। ছত্রে-ছত্রে অসাধারণ ক্যামেরার কাজ যেন আসলে বাস্তবের গল্পের ওপর দিয়ে একটি পরাবাস্তব ছবি আঁকতে চেয়েছে। প্রাচীন লক্ষ্নৌ নগরীর ক্যানভাসের ওপর ফুটে উঠেছে আধুনিক ক্ষয়িষ্ণু নাগরিক জীবন, যেখানে রেশমাত্র নেই কোনো নবাবীয়ানার। না, এটা ঠিক সিনেমার রিভিউ নয়। তাই, গল্পের ঘনঘটা বা আরো আনুষঙ্গিক চরিত্রচর্চা, প্রযুক্তিগত দিক, বা কোনোরকম স্কুলবুক ফিল্মমেকিং চর্চা কোনোটাই আজকের বিষয় নয়।
সিনেমা হিসেবে যে 'গুলাবো - সীতাবো' একেবারে ত্রুটিমুক্ত, অসাধারণ তা না বললেও এই ছবির বেশ কিছু কিছু জায়গা কিন্তু চোখে জল এনে দিয়েছে। আর এই অনবদ্য কাজটির জন্য শত শত কুর্নিশ প্রাপ্য বচ্চন সাহেবের। দীর্ঘদেহী নায়ক তাঁর সমস্ত সুঠাম আদর্শবান নায়কত্ব সরিয়ে রেখে যেভাবে বয়সভারে ন্যুব্জ, জীর্ণ নেতিবাচক বৃদ্ধকে বাস্তব করে দিয়ে গেলেন, আর সব ভুলে গেলেও, শুধুমাত্র তার জন্যই ওনাকে বলিউড মনে রাখবে দীর্ঘ সময় ।

No comments:
Post a Comment