না হোক তিনি পুণ্যতোয়া গঙ্গা। ভগীরথের সাধনার ফল কি শুধুই একটিমাত্র ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ? যুগ -যুগ ধরে ঘন্টাধ্বনি সহ যে প্রার্থনা মন্ত্র আবৃত্তি করে জন্ম -মৃত্যু -বিবাহ সমস্ত অবশ্যকর্তব্য সাধিত হয়, সে নেহাতই এক হাইড্রোসাইকেল। সমস্ত নদীতীর্থ থেকে জল এনে উৎসর্গ করা, সরস্বতী- নদী সম জ্ঞানে। সরস্বতী নদী কবেই মুছে গেছে, কিংবা হয়তো শুধুই কল্পনায় ছিল? 'একবার বিরাজ গো মা, হৃদি কমলাসনে!' মাতৃমূর্তিকে হৃদয়ে ধারণ করার এই অসামান্য কবি-কল্পনা ছাড়া কি সাধনা সম্ভব? 'নেতি -নেতি '; বৈরাগ্যের অনলে যাঁরা সব আহুতি দিয়েছেন, সেই সব প্রাজ্ঞ বৈদান্তিক গণ হয়তো পারবেন। আমরা অতি সাধারণ, cattle ক্লাস, নদী আমাদের আবেগপ্রবণ করে তোলে। সব আদি সভ্যতা আদতে নদীমাতৃক। তাই তো জলের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক প্রাণের।
তাই আমার ভাবনায়, mighty মিসিসিপির জাহ্নবী রূপ ধারণে বাধা কোথায়? বয়সভারে ক্লান্ত, ধীরগমনা নদী, পরিণত রমণীর মতো। শিরা-উপশিরা সমেত সুদূর প্রসারিত তাঁর সংসার, দু-কূল ছাপিয়ে ভরন্ত দেহে গজগামিনীর মতো ধারণ করে রেখেছেন এই ইকোসিস্টেম। আর সেই নদীতীরে মাথা চারা দিয়ে দু-বাহু প্রাসারিত কাশফুলরাশি- সঙ্গে নীল আকাশ, আর সাদা মেঘের ভেলা। আগমনী কি কেবলই বঙ্গদেশ যান? এক লহমায় সমস্ত স্পেস-টাইম ফ্যাব্রিকে ঢেউ তুলে বঙ্গভূমি এসে মিশে যায় মেমফিসের তীরে।
নীলনদের তীরবর্তী প্রাচীন নগর মেমফিস, হিয়ারোগ্লিফিক্স লিপির জন্মস্থান, দেবী আইসিস, তুতেনখামেন - সমস্ত রহস্য, মাদকতা নিয়ে কবেই হারিয়ে গেছে বালির সমুদ্রে। শুধু মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে কিছু পিরামিড জানান দেয় সব অতীত-জৌলুশ। ক্লিওপেট্রার কাজল -কালো চোখ আর উন্নত নাসিকার হাতছানি বুকে নিয়ে মিসিসিপির ধারে গড়ে উঠেছে এই শতকের মেমফিস। তুলোর চাষের বাণিজ্য, বর্ণ-বিদ্বেষ, ক্রীতদাস-প্রথা - সিভিল রাইট আন্দোলনের ইতিহাসের অন্যতম প্রধান শহর হলো এই মেমফিস। শ্বেত - শুভ্র কার্পাস ফুলের গায়ে লেগে থাকা মার্টিন লুথার কিংয়ের রক্তের দাগ আজও অমলিন। ঠিক যেন লেডি ম্যাকবেথের মতো, অত্যাচার আর নিপীড়ণের ইতিহাস শত বার ধুয়েও মুছে ফেলা যায়না। সেই সব কথকতা, আর চোখের জল এখনো ব্লুজ হয়ে ঝরে পরে এই নগরীর অলিতে-গলিতে। কান পাতলে শোনা যায় ঠিক।
ঘর ছাড়া প্রবাসী আমরা। মানুষ ঘর ছাড়ে কিসের টানে? সুদূর কোন প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানুষের ধর্ম একটাই - চরৈবেতি! আমিও তাই এগিয়ে চলেছি, এক স্থান থেকে আর এক স্থানে। হৃদয়ে সযত্নে গোছানো সংসার, ফেলে রেখে আসা এক চিলতে নিকোনো উঠোন, এক পরম যত্নে গচ্ছিত রাখা পিছু- টান ।কিন্তু ঘর একদিন ছাড়লে সে ঘরে ফিরে যাওয়া হয়না আর - ঘর থেকে ঘর ঘুরে ঘুরে বেড়াই শুধু । বসুধৈব কুটুম্বকম।
এই দীর্ঘ নোমাডিক জীবনে সবই তাই প্রতীক মাত্র। দুর্গাপুজো একান্তই উমার পিত্রালয়ে প্রত্যাবর্তন। আসলে হোমকামিং সেলিব্রেশন । আমিও ফিরি ঘরে, এই নদী- তীরবর্তী কাশফুলের প্রতীকী রূপ ধরে। সব উমারাই পিতৃগৃহে ফেরেন তাই এই কদিন। কেউ কেউ হয়তো ফিরতেও পারেন নি, ফিরেছে তাঁর ঝলসানো পার্থিব দেহ। ছোটবেলা থেকে অবাক বিস্ময়ে শুনতাম যখন গল্পের মতো কেউ বলতেন - বর্ষাকালের বজ্রনিনাদ আসলে স্বর্গে মা দুর্গার আসন্ন পিত্রালয়ে ভ্রমণ নিয়ে নাকি দেবাদিদেবের সঙ্গে তাঁর কলহ মাত্র। এসব মিসোজিনির তত্ত্ব তালাশ করা আমার কাজ না, তবে ভাবলে অবাক লাগে চালচিত্র ছেড়ে এসে মহামায়া কিভাবে ঘরের মেয়ে হয়ে গেছেন, বোধ করি, ঈশ্বরী পাটনীর হাত ধরে।
কলকাতা হয়ে মেমফিস - গেছোদাদার বাতলে দেওয়া তিব্বত যাওয়ার রাস্তার মতোই সহজ। শুধুই কতক অক্ষরেখা আর দ্রাঘিমা রেখার ফাঁস; নইলে গঙ্গাজল-ও তো মিসিসিপি তেই বহমান। একই সূর্যোদয় হয়, আর একই চাঁদের আলো এসে লাগে নদীর ঢেউএ। তাই এই কাশবনতলেই হোক আজ তাঁর বোধন, নাই বা থাকলো বিল্ব বৃক্ষ।
'ইহা গচ্ছ, ইহা তিষ্ঠ ' বলে অধীর হয়ে ডাকলে কি আর তিনি শুনবেন না?
#তব _অচিন্ত্য _রূপ _চরিত _মহিমা !
পুনঃ একটু দেরি হয়ে গেল, তাই বিলম্বিত শারদ শুভেচ্ছা না জানিয়ে, একেবারে শুভ বিজয়া!

No comments:
Post a Comment