শ্রাবণী পূর্নিমা। বর্ষণ সিক্ত হিমালয় কেঁপে কেঁপে উঠছে জোলো বাতাসে। মেঘ -গম্ভীর আকাশের বুক চিড়ে মাঝে মধ্যে চাঁদের হাসি খেলে যাচ্ছে বিদ্যুতের মত , আর গৈরিক বসন হিমালয় হয়ে উঠছে ধ্যানগম্ভীর। উত্তর দিক থেকে ভেসে আসছে আর্দ্র বাতাস কোন এক নাম না জানা ফুল এর গন্ধ নিয়ে , পাহাড় এর ঐদিকে বোধ করি খুব বৃষ্টি , গেছে ক্ষানিক আগে। দূরের বৌদ্ধ গুহা থেকে ধ্বনিত হচ্ছে বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি ! আবার এক রাশ মেঘ এসে কালো করে দিচ্ছে সব দিক, ওমনি বিরহী যক্ষের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠছে দেবভূমি।
আজ স্বপ্নের মত মায়াবী হয়ে আছে হিমালয়। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ আর পূর্নিমার চাঁদ আকাশে। রাত্রির ঠিক মধ্যভাগ এখন, ঠান্ডায় জলে বাতাসে অন্ধকার জড়াজড়ি করে ঘুমোচ্ছে যেন, কোথাও কেউ নেই আজ। রাত পাখিটাও গান গাইতে ভুলে গেছে যেন কিসের অপেক্ষায়।
রাত দ্বিপ্রহর। বেজে উঠলো সেই বাঁশি।প্রতি শ্রাবনী পূর্নিমা র মত আজ ও সেই বৃদ্ধ সাধক যেন প্রাণ ঢেলে দিয়েছেন বাঁশি তে, আর একটু একটু করে সরস্বতী রাগের আলাপ বিস্তার হচ্ছে। আকাশ- বাতাস- পাহাড় ধ্যান ভেঙ্গে ডুবে যাচ্ছে সেই সরস্বতী র সুর মূর্ছনায়। ক্রমশ সেই সুর যেন সপ্তলোক ভেদ করে গিয়ে পৌঁছলো দেবীর কানে ,অকাল বোধন ঘটলো আবার। জেগে উঠলেন দেবী,অমোঘ সেই আহ্বান।'ইহাগচ্ছ ,ইহতিষ্ঠ !' সুরের পথ বেয়ে ঝর্ণার মতো নেমে আসছেন দেবী। পাহাড়ের প্রতিটি ভাঁজে,গাছের প্রতিটি পাতায় ধীরে ধীরে তাঁর প্রকাশ ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে।
আর সেই বাঁশি বাদক সাধকের অস্তিত্ত যেন নিমজ্জিত রাগিনী র সুরজালে ,নিমীলিত নয়ন, প্রশান্ত বদন,স্নিগ্ধ হাসি।চারিদিকে শুদ্ধতম সরস্বতী রাগের নিপুন স্বরবিস্তার। বহু বছরের চেষ্টায়,বহুদিনের সাধনায় আজ তিনি পূর্ণ,দেবী সরস্বতী তাই আজ ধরা দিয়েছেন, বিশুদ্ধ রাগিনীর সুদ্ধ স্বর আঘাত করেছে প্রতিটি তন্ত্রী তে তাঁর,তাই নেমে এসেছেন বাগদেবী আজ এই হিমালয়ে র কোনে।গাছের পাতায়,মাটির ঘাসে,তুষার শৃঙ্গে,চাঁদের আলোয়,পদ্ম বনে, শিশির কণিকায়।
বাঁশি বেজে চলেছে একমনে,দেবভূমি যেন এক ছন্দে কম্পমান। আর ,একটু একটু করে প্রকাশিত হচ্ছেন দেবী স্বশরীরে। "যা কুন্দেন্দু তুষারহারধবলা।.."। একটু একটু করে জমাট বাঁধছে জ্যোতি , স্থির চপলা সরস্বতী আবির্ভূত হচ্ছেন। নিরাকার থেকে সাকার রূপ ধারণ করছেন। সমগ্র হিমালয় নতমস্তকে আহ্বান জানাচ্ছে , সাধক এখন সিদ্ধ লাভের প্রাক্কালে। ইষ্ট দেবী অভির্ভুতা হয়েছেন তাঁর আহ্বানে।
বাঁশি শেষ হলো অবশেষে , রাত্রি শেষ হয়ে এসেছে , চাঁদ ঢলে পড়েছে পশ্চিম গগনে। জমাট বেঁধেছে মেঘ আবার ঈশান কোনে। দেবী বন্দিনী হলেন আজ,সাধকের তন্ত্রী তে। সাধক তাঁর বাঁশি সমর্পন করলেন দেবীর পদতলে।
সবাই দেখল পরদিন সকালে,সাধক দেহত্যাগ করেছেন পাহাড়ের গায়ে রাত্রির কোন এক প্রহরে।
উন্মুক্ত হিমালয়ের কোলে বসে,নক্ষত্রের আলোকে জীবনের শ্রেষ্ঠ বাজনা বাজিয়েছিলেন তিনি সেই রাতে। পারি দিয়েছেন গন্ধর্বলোকে ,দেবী সরস্বতী র হাত ধরে।
No comments:
Post a Comment