Friday, January 1, 2021

অজ্ঞাতবাস - a Saudade

" মনে পরে যায় গত জন্মের পাপ 
শরীরে রয়েছে চেনা শরীরের ছাপ 
তুমি নত মুখে মেনে নিলে অভিশাপ 
সাদা হিমঘর জুড়ে শীতঘুম। "



চিত্রঋন: Unsplash 





দিকচক্রবালে তাকিয়ে পড়ন্ত বিকেলের শেষ আঁচ টুকু বোঝার আগেই ঝুপ করে নেমে আসে গভীর সন্ধ্যা, এক দীর্ঘ শীতল রাত্রির প্রতিশ্রুতি নিয়ে। মেরুবায়ু বয়ে আসে, ঝুরো ঝুরো বরফ ভর্তি অতলান্তিক বিষাদ। ক্রমে অন্ধকার আরো গভীর হয়। অমাবস্যার তারকাখচিত রাতে প্রহরীর মতো জেগে থাকে ছায়াপথ। শীতল বরফে পাইন গাছের তলায় শেয়ালের আনাগোনা। সরীসৃপের মতো শীতঘুম চারিদিক পেঁচিয়ে ধরতে চায়। তারার আলোয় পথ খুঁজে বেড়ায় ক্লান্ত পথিক। বসার সময় নেই তার। শ্রান্ত শরীর ঠেলে নিয়ে যায় বরফ ভেঙে। যেতে হবে অনেক দূরে, সেই যেখানে,  নীলনয়না ডেসডিমোনা, দিন গুনছে তার পথ চেয়ে । ঐ নীল চোখে সে সমুদ্রের ঢেউ দেখতে পায়। উষ্ণ সমুদ্রে জীবনের গর্জন। ঢেউ উঠছে, আর ভেঙে পড়ছে। সমুদ্রে যাবে সে। 

 সমৃদ্ধ নগরী ভেনিস। শহর-ময় প্রণালী, সদা ব্যস্ত গন্ডোলার আনাগোনায়।শোরগোল লেগেই আছে বন্দরে, জেলে-মাঝিদের ভীড়ে। সর্বদাই জাহাজের আনাগোনা। জাহাজীরা এসে ভীড় করে সরাইখানা কিংবা গণিকালয়ে। এ শহরে রাত সর্বদা রঙ্গীন। ভাগ্য ফেরানোর আশায় প্রাচ্যের বণিককুল এসে নামে, নীল বিক্রির তাগিদে, পোশাকি নাম ইন্ডিগো। তারা শুনেছে এড্রিয়াটিক তীরবর্তী ভেনিস বড়ো মনোরম জায়গা। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ভেসে যায় জাহাজ। শেষ বারের মতো নাবিক আলিঙ্গন করে নেয় প্ৰেয়সী কে। হয়তো চোখের জল ধরে রাখতে পারেনা। আর কোনোদিন দেখা হবে কি তাদের ? কোলাহল - শোরগোল- মদ- নারী- জৌলুশ- বাণিজ্যের হাতছানি। জেলেদের নিলাম-দর। শুকনো মাছের গন্ধ, সী - গালের পালক। টাটকা সমুদ্রের নোনতা গন্ধ বাতাসে। মধ্যযুগের ভেনিস এক মায়াবী রাজ্য। 


সূর্যাস্তের শেষ আভাটুকু দেখতে প্রতিদিন জানলার ধারের একফালি বারান্দায় আসে ডেসডিমোনা। দূর থেকে বন্দরের ভীড় দেখা যায়, শোরগোল ভেসে আসে নোনা হাওয়ায়। উদাসী চোখ মেলে সে খোঁজে এক অতি পরিচিত অবয়ব কে।কথা দিয়েছিলো, একদিন সে আসবেই, এই পিঞ্জরাবদ্ধ পাখি কে মুক্ত করতে। কোনোদিন খুঁজে পায়না ডেসডিমোনা তাকে , তবু  জানে, একদিন সে আসবেই। কথা সে রাখবেই। বন্দিনী রাজনন্দিনীর মতো ডেসডিমোনা। রাজপুত্রের আশায় রোজ জ্বালিয়ে রাখে পিলসুজ, ঘরের কুলুঙ্গিতে। রাত্রি গভীর হলে, শহরের কোলাহল ক্রমে কমে আসে। সে আবার তখন এসে দাঁড়ায় পেছনের বারান্দায়। অন্ধকার আকাশ ঘিরে ধরে তাকে। কবরীবদ্ধ লম্বা চুল মেলে দেয় তখন। চোখ বন্ধ করে ফিসফিসিয়ে  প্রশ্ন করে সে নোনা বাতাসের কাছে। আর, এক ফোঁটা স্বাতী নক্ষত্রের জল এসে পরে তার মাথায়। 

- তবে সে কি শুধুই মিথ্যা আশা?
- ধৈর্য ধর, একদিন সে আসবেই। শুধু তোমাকে নিতেই সে আসবে। 
- ঈশ্বর, এ কেমন প্রেম? যেখানে শুধুই বিষাদ? 
- যে প্রেমে বিরহ নেই, যেখানে মিলনের পথে কোনো বাধা নেই, সে প্রেম মিছে।

আর একটি রাত কেটে যায়। সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে গীর্জার ধ্বনি বেজে ওঠে। মোমদানির মোমের শেষ আলোটুকু মিলিয়ে যায় সূর্যের কাছে নতজানু হয়ে। এই যে বেঁচে থাকা তার মধ্যে এক অনন্তের হাতছানি আছে। 

পৃথিবীর অপর প্রান্তে তখন সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বলে উঠছে ধীরে ধীরে।কুলবধূর শাঁখের আওয়াজে তুলসীতলা মাতোয়ারা। সকল গোপিনী ঘরে ফিরে আসে।শ্রী রাধিকার উদাস নয়ন যমুনার ধারে। আজ তো বাঁশি শুনলাম না? ঈশান কোনে ঘনিয়ে আসে নববর্ষা। পূবালী হওয়া বয়। উড়িয়ে দেয় রাধিকা তার আঁচল হাওয়ায়  - যাক উড়ে যাক। এ রূপ, এ যৌবন এ মধুবন, এ কুঞ্জ, সব যে বৃথা তাঁকে ছাড়া। সযত্নে রক্ষিত ভালোবাসার সব স্মৃতি তার শরীর জুড়ে, পরতে পরতে। এত কাছে তবু তাকে পাওয়া যায় না। গোপন অভিসারে যে ঘনশ্যাম কে আঁকড়ে ধরে রাধিকা বাঁচে, তিনি যে তার হতে হতেও হন না। পূবালী হওয়া বয়, জলের কথা বয়ে আনে কানে। 

- সে প্রেম কেমন, যাকে  আমার বলে পাইনা ?
-পেয়ে গেলেই তো শেষ। অপেক্ষাই তো প্রেম। 

একটি একটি করে দিন কাটে। বৃষ্টি থেমে যায়, সন্ধ্যামালতী ফোটে। তোমাকে দেখেছি আমি রাত্রিশেষের বেলায়। তোমাকে দেখেছি আমি উল্কাপাতের আলোয়। ভোরের সুবাসে, দু চোখের পরম মায়ায়। এ জন্মের মতো প্রেম হয়েও হলো না আর। জলের শব্দেরা গান গেয়ে যায়, পরজন্মের কথা বলে শুধু। এই জন্ম যে শুধুই অপেক্ষা।এ এক অজ্ঞাতবাস। 

নীলনয়না সুন্দরী অভিশাপগ্রস্তা। কবে কোন দুর্বাসামুনির অভিশাপ কে জানে। প্রেমের সব প্রতিশ্রুতি দিয়েও সেই প্রেমিক প্রবর যেন হিমশীতল সমাধিতে - একটা আবর্তের মধ্যে সমায়িত। আকাশ- বাতাস ফুঁড়ে কেউ বলে ওঠে,

-'পথিক তুমি কি পথ হারিয়েছো?'
-' হ্যাঁ , সমুদ্রে যাবো আমি, এই হিমশীতল উপত্যকা আমার দেশ নয়'

দুহাতে বরফ সরায় সেই প্রেমিক পথিক। আকুল নয়নে সে সমুদ্রের পথ খুঁজছে। নীল সমুদ্রের কাছে পৌঁছতেই হবে তাকে। ডেসডিমোনা , ডেসডিমোনা ! বাতাসে সমুদ্রের ঘ্রান। তবু খুঁজে পায়না। নীল সমুদ্র এক মহা সমুদ্র। প্রাণের আবির্ভাব তো সমুদ্রেই হয়েছিল। এ এক জন্ম যন্ত্রনা, যেখানে অশরীরী খুঁজে বেড়ায় মাতৃ গর্ভ। 


প্রকান্ড শব্দ করে মিলিয়ে গেল সাবওয়ে সামনে থেকে। নেমে আসে যুবক এক পৃথিবী জনতার একজন হয়ে। চলমান সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসে পাতাল থেকে, টাইমস-স্কয়ারে। লোকে-লোকারণ্য চারিদিক। নীল-বসনা, নীল-নয়না।সারাজীবন ধরে সেই প্রেম সে খুঁজে বেড়ায় পরশপাথরের মতো । জন্ম থেকে জন্মান্তর - খুঁজে পেলো কি তাকে ? না, প্রেম তো চিরকালীন এক মিলনের তপস্যা। বলেছিলাম না, দুর্বাসা মুনির অভিশাপ রয়েছে। আর সেই ডেসডিমোনা, কিংবা রাধিকা তাদের কি হলো? তারা এখনো বন্দিনী। এখনো আশা করে তারা, রাজপুত্র আসবে একদিন, এ অজ্ঞাতবাস শেষ হবে একদিন। কেউ বা বাসর ঘরে, কেউ হয়তো ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরি রুমে, তবু রোজ চাঁদ ওঠে আর অস্ত যায়। 



* চন্দ্রবিন্দু 


1 comment:

  1. Asadharon hoyechhe Debisree...Deep aar ami ekhuni porlam. Keep it up.

    ReplyDelete